কেন চুল পড়ে?

চুল পড়ার সমস্যা ও প্রতিকার

চুল পড়া, চুল উঠে যাওয়া বা চুল পাতলা হয়ে যাওয়া নিয়ে আমাদের চিন্তার অন্ত নেই। ছেলেমেয়ে সবাই এর শিকার। বংশগত অথবা হরমোনাল কারণে অথবা শারীরিক কিছু সমস্যায় আমাদের মাথার কিছু অংশ অথবা পুরো মাথা থেকে চুল পড়তে থাকে। প্রতিদিন মানুষের মাথা থেকে ১০০টি পর্যন্ত চুল এমনিতেই ঝরে পড়ে। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু অনেকের এর চেয়েও অনেক বেশি মাত্রায় চুল পড়ে যায়।

কেন চুল পড়ে? এই বিষয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে যে, শরীরে প্রোটিন এবং ভিটামিনের অভাব থেকে চুল পড়তে পারে। কিংবা থাইরয়েডের কোনো সমস্যা, মানসিক চাপ, ডায়েটিং, হরমোনের তারতম্য কিংবা কিছু কিছু ওষুধ সেবনও চুল পড়ার কারণ হতে পারে। স্বাভাবিকভাবে একেকটি চুল মাথায় ২ বছর থেকে ৮ বছর নাগাদ পর্যন্ত থাকতে পারে। এরপর এটি এমনিতেই ঝরে যায়। কিন্তু স্বাভাবিকতার বাইরে যখন চুল পড়ে, সেটাই হয় চিন্তার কারণ। চলুন জেনে নেওয়া যাক ঠিক কী কী কারণে চুল ঝরে যায় –

পুষ্টির অভাব

শরীরের পুষ্টির ওপর চুলের স্বাস্থ্য নির্ভর করে। শরীরে পুষ্টির ঘাটতি থাকলে চুল পড়ার হার বেড়ে যায়। বিশেষ করে দীর্ঘদিন যদি চুল কোনো একটি পুষ্টি উপাদান না পায় সে ক্ষেত্রে চুল দুর্বল হয়ে ঝরে পড়ে। এজন্য দৈনিক খাদ্য তালিকায় যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার রাখতে হবে।

হরমোনের কারণে

বিভিন্ন রকম হরমোনের কারণে অতিরিক্ত চুল পড়তে পারে। বিশেষ করে অ্যান্ড্রোজেনিক হরমোনের কারণে চুলের পরিমাণ কমে যায় মাথায়। অ্যান্ড্রোজেনিক হরমোন নারীর চুল পড়া ও পুরুষের টাকের সবচেয়ে বড় কারণ। এই হরমোন সাধারণত পুরুষের শরীরে বেশি পরিমাণে থাকে। যাদের শরীরে এই হরমোনের প্রভাব বেশি, তাদেরই বেশি করে চুল পড়ে।

মানসিক দুশ্চিন্তা

মানসিক অস্থিরতা বা দুশ্চিন্তায় পড়লেও মাথার চুলে প্রভাব পড়ে। এর ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যে অনেক চুল পড়ে যায়। দুশ্চিন্তার ফলে চুল শুধু ঝরে পড়ে না, এটি চুলকে পাকিয়েও ফেলে। দীর্ঘদিন মানসিক চাপে ভুগলে পুরুষদের মাথা টাক হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তবে দুশ্চিন্তা কাটিয়ে উঠলে আবার চুল গজানোর সম্ভাবনা থাকে।

ছত্রাকের আক্রমণ

ছত্রাক সংক্রমণ বা খুশকি হলো চুল পড়ার অন্যতম কারণ। মাথার ত্বকে নানা রকম ছত্রাক আক্রমণ করতে পারে। এর ফলে চুলের গোড়া দুর্বল হয়ে পড়ে এবং চুল সহজেই উঠে আসে। খুশকির কারণেও একই সমস্যার সৃষ্টি হয়। এজন্য ছত্রাক মুক্ত করে বা এন্টিড্যান্ড্রফ শ্যাম্পু ব্যবহার করে সুফল পেতে পারেন।

প্রসাধনীর ব্যবহার

নিজেকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে অনেকেই চুলের মধ্যে নানা রকম প্রসাধনী ব্যবহার করে থাকেন। বিশেষ করে বিভিন্ন রকম হেয়ার জেল এবং চুল রঙিন করার প্রসাধনী এ ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতি করে থাকে। এছাড়াও চুল একভাবে অনেকদিন বেঁধে রাখাকেও চুল পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন চুল বিশেষজ্ঞরা।

ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক বা এই ধাঁচের ওষুধের কারণেও চুল পড়ে যায় অনেকের। এছাড়াও জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি, প্রেসারের ওষুধ, রক্ত তরলীকরণের ওষুধ, হরমোন, মানসিক অসুস্থতার ওষুধও চুল পড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে।

অসুখে পড়লে

কিছু অসুখ আছে যার ফলে মাথার চুল অনেক পড়ে যায়। যেমন টাইফয়েড, এনিমিয়া, জন্ডিস, ডায়াবেটিস ইত্যাদি। এইসব রোগে যারা আক্রান্ত হোন অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের মাথার চুল অনেক পড়ে যায় এবং রোগ সারার পর তা আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না।

এছাড়া, শরীরে বড় কোনো অস্ত্রোপচার বা অপারেশনের পর বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ, শারীরিক পরিবর্তন অথবা মানসিক উদ্বেগের কারণে অনেক সময় চুল পড়ে যেতে পারে। তবে সুস্থ হওয়ার পর চার থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে চুল আগের অবস্থায় ফিরে যায়।

 

চুল পড়া বন্ধের উপায়ঃ

চুল পড়া বন্ধে যেসব খাবার খাবেন তার মধ্যে মাছ, মাংস, ডিম, বাদাম, ডাল ইত্যাদি প্রোটিনযুক্ত খাবার রাখবেন প্রতিদিনের খাবারের তলিকায়। প্রোটিনের অভাব হলে শরীরের মতো চুলের স্বস্থ্যেও কিন্তু বড় ক্ষতি হয়ে থাকে। এছাড়াও চুল পড়া বন্ধে যেসব কাজ করতে হবে-

খাবারের প্রতি যত্নবান হওয়াঃ সুস্থ এবং ঘন চুলের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই। চুলের বৃদ্ধির জন্য আমিষ খুবই প্রয়োজনীয়। তবে চুলের পাশাপাশি শরীরের খেয়াল রাখতে হলে অবশ্যই চর্বিহীন আমিষ খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। মাছে প্রচুর পরিমাণ চর্বিহীন আমিষ থাকে। তাছাড়া চর্বিহীন মাংস মানবদেহের আমিষের চাহিদা পূরণ করে থাকে। বাদাম পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ভোজ্য বীজে প্রচুর ভিটামিন ই এবং স্বাস্থ্যকর স্নেহ পদার্থ থাকে যা চুলে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা ও পুষ্টি যোগায়। এমনকি কিছু মশলা চুলের পক্ষে খুবই উপকারী, যেমন: দারুচিনি। বিভিন্ন খাবারে দারুচিনি ব্যবহারের মাধ্যমে চুলের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং পুষ্টির চাহিদা মেটানো সম্ভব।

পর্যাপ্ত পানি পান করাঃ চুলের ২৫ শতাংশ গ্রন্থি পানি দ্বারা গঠিত। দেহে পানির অভাব দেখা দিলে চুলের গ্রন্থিগুলো দুর্বল হয়ে যায় ফলে চুলের ঘনত্ব কমে যায় এবং চুল পড়া শুরু হয়। তাছাড়া দেহে পানির অভাব দেখা দিলে নতুন চুলগ্রন্থি তৈরি হয়না ফলে মাথায় চুলের পরিমাণ বাড়ে না।

পর্যাপ্ত ভিটামিন গ্রহন করাঃ মানসিক চাপ, জিনগত সমস্যা এবং বিভিন্ন রোগ ছাড়াও পুরুষদেহে ভিটামিনের অভাব চুল পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ। মাথায় টাক পড়া প্রতিরোধ করতে পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ভিটামিন নিয়মিত গ্রহণ করুন। ভিটামিন এ আপনার চুলের গ্রন্থিতে রেটিনয়িক এসিডের সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ঘটাতে সাহায্য করে, ভিটামিন বি আপনার মানসিক চাপের মাত্রা কমিয়ে দেয়, ভিটামিন সি, ডি এবং ই আপনার দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সংরক্ষণ করতে সহায়তা করে।

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়াঃ আপনার চুল পড়া সমস্যা দূর করার জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ জরুরি। পরিস্থিতি বেগতিক হওয়ার আগে বেশি দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব একজন ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। আপনি কোন কোন ওষুধ সেবন করেন, চুলের জন্য কোন প্রসাধনী ব্যবহার করেন এবং চুল বিষয়ে আপনার পারিবারিক ইতিহাস এক্ষেত্রে জরুরি। অনেক সময় দেখা যায় যে, আপনি যেসকল ওষুধ সেবন করছেন তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আপনার মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় সকল বিষয়াদি পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞ যে পরামর্শ প্রদান করেন তা পালন করুন।

ঔষধ খাওয়াঃ চুল পড়া প্রতিরোধের জন্য বাজারে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ রয়েছে। মিনোক্সিডিল বা রোগেইন এর মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। চুল পড়া প্রতিরোধ এবং পুনরায় চুল গজানোর জন্য রোগেইন বেশ কার্যকরী ওষুধ। রোগেইন হচ্ছে ফেনা তৈরিকারী এক প্রকারের ওষুধ যা দিনে দুই বার আপনি সরাসরি মাথার ত্বকে লাগাতে পারেন। মাথার পেছন এবং সামনের অংশে চুল গজানোর জন্য এটি বেশ কার্যকরী। আরেকটি কার্যকরী ওষুধ হচ্ছে, ফিনাস্টেরাইড বা প্রপেশিয়া যা মুখে খাওয়ার উপযোগী এবং আপনি প্রতিদিন তা গ্রহণ করতে পারেন। যথাযথ ফলাফল পাওয়ার জন্য উভয় ওষুধ আপনাকে প্রতিদিন গ্রহণ করতে হবে। এই দুটি ওষুধ অনেকসময় পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে সঠিক চিকিৎসার জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা না করাঃ অনেকেই আছেন যারা চুল পড়া নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় ভোগেন। ফলাফল হিসেবে চুল পড়ার হার বেড়ে যায়। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার ফলে চুলপড়াজনীত নানারকম সমস্যা বেড়ে যায়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে টেলোজেন এফ্লুভিয়াম (যার ফলে মাথা থেকে আপনাআপনি চুল ঝরে যায়), ট্রিকোটেলোমেনিয়া (যার ফলে বারবার চুল টানার ইচ্ছা জাগে ফলে মাথা থেকে প্রচুর পরিমাণে চুল পড়ে যায়) এবং অ্যালোপেসিয়া এরিয়াটা (যার ফলে চুলের গ্রন্থিগুলো আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার আক্রমণের শিকার হয়)। সুতরাং মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা এড়াতে নিয়মিত বিভিন্ন শারীরিক ব্যায়াম করুন।

ধূমপান বা মদ্যপান না করাঃ আপনি হয়তো জানেন যে অতিরিক্ত ধূমপান এবং মদ্যপানের ফলে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হয়। কিন্তু এগুলোর প্রভাব যে আপনার চুলের ওপর পড়ে তা হয়তো আপনি কল্পনাও করেননি। গবেষণায় দেখা গেছে ধূমপান এবং মদ্যপান চুল পড়ার জন্য দায়ী। ধূমপানের ফলে শরীরের রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। ফলে আপনার চুলের গ্রন্থিগুলোতে সঠিক মাত্রায় রক্তপ্রবাহ না থাকায় চুল পড়া শুরু হয়। অন্যদিকে মদ্যপানের ফলে শরীরে পানিশূন্যতা এবং নানানরকম পুষ্টিজনিত সমস্যা দেখা দেয়। ফলে চুল পড়ার হার বৃদ্ধি পায়।

 

ব্যায়াম করাঃ নিয়মিত ব্যায়ামের ফলে যেমন শরীর সুস্থ থাকে, তেমনি আপনার চুলের জন্যও উপকারী। ব্যায়ামের ফলে মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা দূরে থাকে এবং শরীরে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায় যা চুলের বৃদ্ধি ঘটাতে সহায়তা করে।

 

চুলে গরম পানি ব্যবহার করবেন না, গরম পানি চুলকে রুক্ষ ও নষ্ট করে। ফলে কুসুম কুসুম গরম পানি দিয়ে ভালো করে চুল ধুয়ে, সবশেষে ঠান্ডা পানি দিয়ে মাথা ধুয়ে ফেলবেন। তাছাড়া মাথা ঘষে ঘষে মুছবেন না। এতে চুলে টান পড়ে ও চুল ছিড়ে যায়।

চুল পড়া রোধ বা কমাতে হলে চুলকে নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে, নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন যাপন করতে হবে, যেকোনো ওষুধ গ্রহণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।